সূরা বাকারার ১৭২ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ বলেন,
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা পবিত্র বস্তু সামগ্রী আহার কর, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রুযী হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় কর আল্লাহর, যদি তোমরা একান্তভাবে শুধু তাঁরই বন্দেগী কর।”
এই আয়াতে খাবার সংক্রান্ত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে। এর প্রত্যেকটিই আমাদের তাওহীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
প্রথমটা হল, আল্লাহ আমাদের নির্দিষ্ট একটি খাবার খেতে বলেননি। তিনি বিশেষভাবে যে সকল খাবার ‘তাইয়্যিব‘ সেগুলো খেতে বলেছেন। অর্থাৎ শুধু স্বাদসর্বস্ব খাবার নয় যা স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো, পুষ্টিকর, স্বাস্থ্যকর এবং উপকারী সেগুলো খেতে বলেছেন। এর কারণ হল আমাদের দেহটা আসলে ‘আমাদের’ নয়, এটি আমাদের উপর অর্পিত একটি আমানাত। একটি অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পাথেয় হিসাবে আমাদের এই আমানাতটি দেওয়া হয়েছে। আর সেই অভীষ্ট লক্ষ্য হচ্ছে আল্লাহর ইবাদাত। এই কারণে, আল্লাহ কুরআনের কিছু অংশ জুড়ে শুধু খাবার হিসেবে আমাদের জন্য কী উত্তম সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিতে কথা বলেছেন। আর আল্লাহর নির্দেশনা মোতাবেক তাইয়্যিবাত গ্রহণের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর দেওয়া এই আমানতকে সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে পারব। মাটির তলা থেকে বের হয়ে আমাদের পেটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যে খাবারগুলোর চেহারা একই থাকে সেগুলোই হচ্ছে সর্বোত্তম খাবার। কারণ এগুলোতে কোনো আকর্ষণীয় মোড়ক আর বাহারী রঙ থাকে না। শাকসবজি ও ফলমূলে আছে ফাইটোক্যামিক্যালস আর মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস যা আমাদের শরীরকে ক্রমাগত সচল ও কার্যকরী রাখার প্রক্রিয়াকে জিইয়ে রাখে। ওজন বেড়ে গেলে শরীরের এই প্রক্রিয়াগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর পরিণামে রক্তে চিনি ও চর্বির পরিমাণ এবং উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। ফলে ধমনীর ক্ষতি হয়। দিনে পাঁচ বেলা সবজি খেলেও হৃদরোগ এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা ততটা থাকে না, যতটা দুই বেলা অন্য খাওয়া খেলে থাকে। আর টমেটো, ফুলকপি ও অন্যান্য সবুজ শাক-সবজি বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হল, এই আয়াত আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, আল্লাহই হলেন এইসব খাবারের যোগানদাতা। প্রতিবারই যখন আমরা আঙ্গুল বা চামচে করে একটুখানি খাবার মুখে তুলে নিই, ততবারই তা যেন দেখিয়ে দেয় এই পৃথিবীতে আমরা আল্লাহর কতটা মুখাপেক্ষী। আপনি যতই ধনী বা গরীব হোন, হোন বিখ্যাত বা অখ্যাত কেউ, অথবা সবল কিংবা দুর্বল; দুনিয়ার প্রতিটি মানুষই তার নিজের চাইতেও বড় বা শক্তিশালী কিছুর মুখাপেক্ষী। আমরা কে আর আমরা কে নই, খাবারই আমাদের সেটা জানিয়ে দেয়। কেউ অন্যের উপর যতই ক্ষমতাবান হোক না কেন, এই ক্ষমতা যে মিছে ভ্রম ছাড়া কিছুই নয় তা খাবারের ব্যাপার আসলেই বোঝা যায়। তখন সে আর আট-দশটি সৃষ্টিরই অনুরূপ, স্রষ্টার অনুগ্রহে বেঁচে থাকা এক সৃষ্টি। এই লেখাটি যারা পড়ছেন, তাদের বেশিরভাগেরই হয়তো কোনো বেলা অভুক্ত হয়ে থাকতে হয় না। কিন্তু খেয়াল করুন, খেতে বসে খাবারের স্বাদ-গন্ধ-বৈচিত্র্য, রন্ধন-কৌশলসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমরা মুখ্য আলোচনা থেকেই দূরে সরে যাই। পরিবার-পরিজন আর বন্ধু-বান্ধব নিয়ে খেতে বসে আমরা একটা গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতার ব্যাপারে অসচেতন হয়ে পড়ছি। আর তা হল: মানুষ হিসেবে আল্লাহর উপর আমাদের নির্ভরতা। আল্লাহর দিকে আমাদের চেয়ে থাকা। আমরা ভুলে যাচ্ছি, আমরা আল্লাহর তুলনায় কতই না দুর্বল। আর আমাদের তুলনায় আল্লাহ কতই না শক্তিশালী! এই মহাসত্য আমরা উপলব্ধি করতে ভুলে যাই। খাবারের যোগান দেয়াটা আল্লাহর একটি অনন্য গুণ যা আল্লাহ সূরা আয-যারিয়াত এর ৫৭ নাম্বার আয়াতে বলেছেন, “….এবং (তাদের কাছে আমি) এটাও চাই না যে, তারা আমাকে আহার্য যোগাবে”, সৃষ্টি আর স্রষ্টার মাঝে খাবারের যোগান দেওয়ার বিষয়টিকে একটি পার্থক্যকারী বৈশিষ্ট্য হিসেবে আল্লাহ চিহ্নিত করেছেন।
আর সত্যিই, এই জেলখানায় খাবার দিতে নির্ধারিত সময় থেকে মাত্র ৩০ মিনিট দেরি হলেই কয়েদিরা ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি আর দরজায় আঘাত করা শুরু করে দেয়। এটি যেন মানুষের সীমাবদ্ধতা আর পরমুখাপেক্ষীতার বাস্তব প্রদর্শনী। কাজেই, আজকের পর থেকে যখন আপনি কোনো খাবার অথবা নাশতা উপভোগ করতে বসবেন, অবশ্যই এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও বাস্তবতা অনুধাবন করে তা উপভোগ করবেন।
সবশেষে, উপরে বর্ণিত বাস্তবতার উপলব্ধি আপনাকে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার দিকে ধাবিত করবে। সহীহ মুসলিম-এ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সন্তুষ্ট হন তাঁর বান্দার ওপর, যখন সে কিছু খাবার খায় আর আল্লাহর প্রশংসা করে।’ এটা একই সাথে তাওহীদের বহিঃপ্রকাশ এবং এই রুঢ় বাস্তবতার স্বীকৃতি, যে এই ছোট্ট খাবারের টুকরোটা লক্ষ লক্ষ মুসলিম ভাই- যাদের আপনি হয়ত আপনার জীবনে কোনোদিন দেখেনও নি- তাদের চোখে এই টুকরোটি একটা কল্পনা মাত্র। যার কেবল স্বপ্নই দেখা চলে। সোমালিয়া বা হাইতির ভয়াবহ লাগামহীন দুর্ভিক্ষের দিকে তাকিয়ে দেখুন। খাবার কিছুক্ষণের মধ্যে আসবেই এই নিশ্চয়তা থাকার পরও আমার চারপাশের কয়েদীরা একটু দেরীতেই অস্থির হয়ে দরজায় আঘাত করা শুরু করে দেয়। অথচ এক মুহূর্ত ভাবুন তো, আপনার দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোথাও কোনো খাবার নেই। আপনার কোনো নিশ্চয়তা নেই যে আপনি সারাদিন বা সারা সপ্তাহ কিছু মুখে দিতে পারবেন কি না। কি করবেন আপনি? এহেন পরিস্থিতিতে বসবাসকারী একজন ব্যক্তি যে দুঃস্বপ্নের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করেন তা পশ্চিমা ধনী দেশের দরিদ্রতম লোকটিও কল্পনা করতে পারবে না। এমন দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেতে উন্মাদের মত ছোটাছুটি করা ছাড়া আর কীইবা করা আছে? ভাবুন তো, আপনার নিজের ক্ষুৎ-পিপাসার সাথে যদি স্ত্রী আর সন্তানদের অনাহারক্লিষ্ট মুখ যোগ হয় তাহলে আপনার কেমন লাগবে? খুশির কথা, এই কল্পনা শুধুই ক্ষণিকের জন্যে আপনার মাথার একটা ছোট্ট অংশ জুড়ে বিদ্যমান থাকবে। কিন্তু এ দুনিয়ায় আপনার চোখের আড়ালের লাখো মানুষের জন্যে এটাই বাস্তবতা। এটাই জীবন, ভাবতে না চাইলেও ভাবতে হবেই। এই জীবন থেকে পালিয়ে বেড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। যে ব্যক্তি মন-প্রাণ ভরে খাবার খায়, অথচ এ খাবারের সন্ধানদাতা (আল্লাহ) ও প্রকৃত অর্থে অমূল্য এই খাবারের সঠিক মূল্যায়ন করতে জানে না, সে আসলে এই খাবার খাওয়ারই যোগ্য নয়।
আল-ইমাম আল আওযা’ই (রহিমাহুল্লাহ) একবার দামাস্কাস থেকে শাম উপকূলে যাত্রা করছিলেন। পথিমধ্যে তার এক বন্ধুর শহরে তাকে থামতে হল। বন্ধুটি তাদের দুইজনের জন্যেই রাতের খাবার তৈরি করল। যখন তারা খেতে বসলেন, বন্ধুটি বললেন, “হে আবু ‘আমার! খাও। আর আমাকে ক্ষমা কর। কারণ, তুমি এমন একসময় এলে যখন আমি কিছুটা টানাপোড়েনে আছি।”ইমাম আওযা’ই তাঁর হাত সরিয়ে নিলেন এবং খাবার গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকলেন। বন্ধুটি বারবার তাঁকে খাওয়ার জন্যে অনুরোধ করতে লাগলেন কিন্তু তিনি প্রতিবারই অস্বীকৃতি জানালেন। শেষ পর্যন্ত বন্ধুটি খাবার গুছিয়ে ফেললেন। তারপর দুজনেই শুয়ে পড়লেন। পরদিন সকালে উঠে বন্ধুটি ইমাম আওযা’ইকে প্রশ্ন করলেন, ‘কাল রাতে তুমি খেলে না কেন?” আল আওযা’ই জবাবে বললেন, “আমি সেই খাবার ছুঁয়ে দেখতে চাইনি যে খাবারের জন্যে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়নি বা যে খাবার সামনে নিয়ে আল্লাহর নি’আমত সেই খাবারকেই ছোট করে দেখা হয়েছে।
তাই খাওয়া-দাওয়ার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তাওহীদ।
তারিক মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেশন ইউনিট #১০৮