সূরা বাক্বারার ১৫৩ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
“হে মুমিন গণ! তোমরা সবর ও সালাতের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর…”
জেলখানার এই ছোট্ট কামরায় এই আয়াতটির অর্থ আমার কাছে খুব পরিষ্কারভাবে ধরা দেয়। এ আয়াতে বর্ণিত সবর ও সালাতের একীভূত করার ব্যাপারটি আমি কারাগারে বসেই উপলব্ধি করতে পেরেছি। এই দুটো ইবাদাতকে একসাথে উল্লেখ করার তাৎপর্য সম্পর্কে আমি কিছু কথা বলতে চাই।
নীচের পাঁচটি পদ্ধতিতে সালাত আপনাকে ধৈর্য ধরার অর্থাৎ সবরের শিক্ষা দেয়:
সালাতের সময় আপনি মাটিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়ান,রুকুতে মাথা নীচু করেন এবং সিজদায় অবনত হন। সালাতের পুরো সময়টা ধরে আপনি শারীরিকভাবে নিজেকে এটাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে আপনি একজন “নিয়ন্ত্রিত সত্তা” আর আপনি বিশ্বজগতের একমাত্র পালনকর্তা ও নিয়ন্ত্রকের ইবাদত করছেন। এভাবে চিন্তা করলে আপনার উপর বিপদাপদ যা কিছুই আপতিত হোক না কেন সবকিছুর মাঝে হাসিমুখে, সন্তুষ্টচিত্তে বেঁচে থাকা আপনার জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়। কেননা এটা আপনাকে নিজের সঠিক অবস্থান উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। আপনি কেবলই আপনার মালিকের একজন অনুগত দাস। যে মালিকের জন্য আপনি নিজের পবিত্র মুখমণ্ডল মাটিতে স্পর্শ করেছেন, সেই মালিকই আপনাকে আজকের পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছেন। তিনিই আপনাকে রোগ-শোক দিয়েছেন, অথবা সম্পদ থেকে বঞ্চিত করছেন, কিংবা কোনো সংকটময় পরিস্থিতির মুখোমুখি করেছেন। আপনি যখন সিজদায় মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আনুগত্যের সাথে বলতে থাকেন: “সুবহানা রাব্বি আল-আ’লা”, তখন আপনি সেই রবের সাথে আপনার সম্পর্কটিকে উপলব্ধি করেন। আপনি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, যেভাবে আমি আল্লাহর সামনে নিজের মুখমণ্ডল মাটিতে অর্পণ করছি, ঠিক একইভাবে আমার সমগ্র সত্তাকে আল্লাহর বেধে দেওয়া নিয়তির কাছে নতমস্তকে সমর্পণ করলাম। সালাত আপনাকে একটি পরম বাস্তবতা উপলব্ধি করতে শেখায়। আর তা হল, মহান আল্লাহ হচ্ছেন সৃষ্টিজগতের একমাত্র নিয়ন্ত্রক এবং আপনি তাঁর আজ্ঞাবহ দাস।
সালাত আপনার মধ্যে একধরনের শৃঙ্খলাবোধ গড়ে তুলবে। এই শৃঙ্খলাবোধ আপনাকে চরম অস্থিরতার মুহূর্তেও সুস্থির রাখবে। যেমন: যথাযথভাবে সালাত আদায় করার অর্থ হল আপনাকে অবশ্যই সময়-সচেতন হতে হবে এবং নির্দিষ্ট ওয়াক্তের মাঝে সালাত আদায় করে নিতে হবে। প্রত্যেক সালাতে নির্দিষ্ট সংখ্যক রাক’আত আদায় করতে হবে। আপনাকে অবশ্যই শান্ত ও ধীর-স্থিরভাবে সালাত আদায় করতে হবে। কোনোক্রমেই কোনো সালাত বাদ দিতে পারবেন না। এমন আরো অনেক কিছু সালাতের ক্ষেত্রে আপনি মেনে চলতে বাধ্য। এভাবে সালাত আদায় মাধ্যমে আপনি নিজেকে নিয়মানুবর্তী করে গড়ে তুলতে পারবেন। আপনি জেলখানায় বন্দী বা আপনার চাকরি নেই- এই অজুহাতে আপনি সালাত ত্যাগ করতে পারবেন না। সালাত আপনাকে নিয়ন্ত্রিত করে। আপনার চরিত্র গঠন করে। যাচ্ছেতাই জীবনযাপনের অভিশাপ থেকে মুক্ত করে আপনার জীবনকে সুশৃঙ্খল করে। জীবনে এমন কিছু কঠিন সময় আসে যখন মানুষ ভেঙে পড়ে। সালাত আপনাকে এমন সময়েও ধীরস্থির থাকতে সাহায্য করবে।
সময়ের সঠিক ব্যবহারে সালাত আপনাকে সহায়তা করে। সত্যি বলতে কি, আমি এই জেলে বসে আমার দিনগুলোকে সালাতের ওয়াক্তের ভিত্তিতেই ভাগ করি। যেমনঃ ফজর ও যোহরের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য কিছু কাজ নির্দিষ্ট করা থাকে। আবার যোহর থেকে আসর পর্যন্ত সময়টা আমি অন্য কিছু কাজের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখি। এমনি করে যখন জেলখানার বাকিরা দীর্ঘ, বিরক্তিকর, উদ্দেশ্যহীন সময় কাটিয়ে দিনাতিপাত করে তখন প্রতিদিনই আমার অনেকগুলো কাজ করা হয়ে যায়। অথচ জেলের বাকিদের দিনগুলো ক্যালেন্ডারের পাতার মতো। একটার সাথে আরেকটার পার্থক্য শুধু তারিখে। ধৈর্য্যশীল হবার জন্য ফলপ্রসূ সময় কাটানোটা খুবই জরুরি।
সালাতকে আত্মার জন্য এক ধরনের ব্যায়াম বলা চলে। রাগের সময় একজন মানুষ হাত-পা নাড়িয়ে চিৎকার করে যেভাবে তার মনের জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ করতে চায়, তেমনিভাবে সালাত, বিশেষ করে দু’আ, আপনার মনের কথাগুলো সর্বশ্রোতা ও জবাবদাতা আল-মুজিবের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ করে দেয়। আপনার যত ফরিয়াদ, যত ইচ্ছা, দুশ্চিন্তা, যত আশা, ক্ষোভ, আবেগ, মনের যত চাপা কথা আছে – সবকিছু মন খুলে বলার এইতো সময়। মনের আগল খুলে দিন। সেখান থেকে বেরিয়ে আসা প্রার্থনা আর দুঃখগুলোকে চোখের জল হয়ে আপনার গাল ছুঁয়ে নেমে আসতে দিন। নিশুতি রাতের শুনশান নীরবতায় কুনুতের জন্য হাত তুলে বিতর সালাতে আপনার রবের সাথে কথা বলুন। আপনার একান্ত, নিজস্ব রবের কাছে আপনার মনের কথাগুলো বলুন। আপনার রব একান্তে আপনার কথাগুলো শুনবেন এবং তিনি নিজে আপনার দু’আর জবাব দেবেন। আপনার মনের অনুভূতিগুলো তাঁকে বলে ফেলুন। জমিয়ে রাখা নালিশগুলো তাঁর কাছেই করুন। যেমনটি ইয়া’কুব (আলাইহিস সালাম) করেছিলেন- “…আমি তো আমার দুঃখ ও অস্থিরতা আল্লাহর সমীপেই নিবেদন করছি…”[সূরা ইউসুফ]। সুতরাং, শরীরচর্চার মধ্য দিয়ে যেভাবে শরীরের উদ্বৃত্ত শক্তি নির্গমন হয়, সালাত তেমনি একটি আধ্যাত্মিক অনুশীলন যার মাধ্যমে আপনি মনের গহীনে জমে থাকা অনুভূতিগুলোকে সুন্দরতম উপায়ে নিঃসরণ করতে পারেন।
সবশেষে, সালাতে কুর’আন তিলাওয়াতের মধ্যে দিয়ে আপনাকে প্রতিনিয়ত আখিরাতের বড় চিত্রটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে। জাহান্নামের চিরস্থায়ী বন্দীদশার বর্ণনা আপনার পার্থিব দুঃখকষ্টগুলোকে তুচ্ছ করে দেয়। জান্নাতের অবর্ণনীয় সুখের বর্ণনা আপনার চারপাশের রূঢ় বাস্তবতা থেকে আপনাকে ক্ষণিকের অবকাশ দেয়। নবী-রাসূলদের সংঘাতময় জীবন সংগ্রাম আপনার মনে সংহতির চেতনা সৃষ্টি করে। একইসাথে আপনাকে এও জানিয়ে দেয় যে, পৃথিবীর সেরা মানুষগুলোর পার্থিব জীবন কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। সালাতের মাঝে কুরআন পাঠ আপনাকে আপনার চারপাশকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে এবং সামনের বন্ধুর পথকে মসৃণ ও পরিচিত করে তোলে।
তারিক্ব মেহান্না
প্লাইমাউথ কারেকশনাল ফ্যাসিলিটি
আইসোলেসন ইউনিট-সেল #১০৬